চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সমস্যা শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম নয়, তাদের সমস্যা আরেফিন সিদ্দিক

উপাচার্য হিসেবে আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের আমলে গত সাড়ে আট বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯০৭ জন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তার মধ্যে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখে হিসাব করে বের করলাম, ১৩২ জনের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনিয়মের মধ্যে রয়েছে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে নিয়োগ, যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেওয়া, ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ না করে প্রার্থী নিয়োগ, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে বেশি শিক্ষক নিয়োগ এবং স্নাতকোত্তর ছাড়াই নিয়োগ।

বলা হচ্ছে, দলীয় রাজনীতির কারণে এবং উপাচার্যের পছন্দের ব্যক্তিকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে অনিয়ম করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারপন্থী নীল দলের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে বর্তমান উপাচার্যের নেতৃত্বে প্রশাসনিক ক্ষমতায় থাকা অংশটি নিজেদের পছন্দ ও অনুগত শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়াতে অনিয়ম করেছে। অনিয়ম হয়ে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে অনিয়ম হলে ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, প্রতিবেদনে তার উল্লেখ পেলাম না। বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন পড়ে যা দেখলাম তা হলো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আসলে বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই।

প্রকাশিত খবর অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরীন আহমাদ নিয়োগ বোর্ডে সভাপতিত্ব করেছেন। তাঁর আগে সহ-উপাচার্য ছিলেন হারুন-অর-রশিদ। বর্তমানে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের প্রধান ও সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদের ভাষ্যমতে, ‘শিক্ষক নিয়োগে একটি শর্ত দেওয়া থাকে; কিন্তু এটাই বেদবাক্য না। ভালো ফলধারী কিংবা সর্বোচ্চ ফলধারীকে নিয়োগ দেওয়া হবে সেটি কোথাও বলা হয়নি। বিভিন্ন যোগ্যতা দেখেই নিয়োগ দেওয়া হয়। যারা ভালো ফলধারী, অনেকেই গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। আবার অপেক্ষাকৃত কম ফলধারীরা গুছিয়ে কথা বলতে পারে। কারো কারো প্রকাশনাও থাকে, তাদেরকে নেওয়া হয়।’

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত শিক্ষক নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রক্রিয়া করতে সময় লাগায় এই সময়ের মধ্যে আরো শিক্ষক নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এ জন্য নতুন করে বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে বেশি নেওয়া হয়।’ প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তিতে যে কটি পদে আবেদন চাওয়া হয়, তা থেকে একজন অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়া যায়।

তো, এক্ষেত্রে অনিয়ম সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে কোন মানদণ্ডে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলে ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী। সেখানে নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে কী বলা আছে কোনো পত্রিকার প্রতিবেদনেই তার উল্লেখ নেই। খটকা লেগেছে এ জায়গাতেই। এতগুলো পত্রিকা যে একসঙ্গে নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন ছেপেছে তার কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি পক্ষ তাদের এই খবরটা সরবরাহ করেছে। ফলে সর্বোচ্চ সাবধান হয়েও রিপোর্টাররা অনিয়ম এবং তা প্রতিরোধে আদৌ ’৭৩-এর অধ্যাদেশে কিছু বলা আছে কি না, তার খোঁজ করেননি। সরবরাহ করা কাগজ পেয়েছেন, লিখেছেন এবং ছাপিয়ে দিয়েছেন। নিয়োগগুলো তো একদিনে হয়নি। তার মানে লম্বা সময় ধরে এই ‘অনিয়ম’ হয়েছে। তো আজ কেন হঠাৎ একযোগে রিপোর্টাররা ঝাপিয়ে পড়ে তথ্য সংগ্রহ করলেন? সেই প্রশ্ন করলেই এ উত্তর পাওয়া যায়।

২.
পত্রিকার রিপোর্টারদের পর আসা যাক শিক্ষক ও শিক্ষক নেতাদের দিকে। প্রথম আলো বলছে, ‘নিয়োগ নিয়ে এমন অনিয়মের ঘটনায় শিক্ষক, সিন্ডিকেটের কোনো কোনো সদস্য লিখিতভাবে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগে ন্যূনতম যোগ্যতা ছাড়াই ছয় শিক্ষক নিয়োগ না দিতে সিন্ডিকেটের কয়েকজন শিক্ষক অনুরোধ জানান। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। শিক্ষকদের একটি অংশের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়ের কমিটিতে বর্তমান উপাচার্য ও প্রশাসনের শক্ত অবস্থান থাকায় সব সিদ্ধান্তই সহজে পাস হয়ে যায়।

আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল থেকে নির্বাচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেছেন, শিক্ষক নিয়োগের এমন হাল নিয়ে তাঁর মতো অনেক শিক্ষকই উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে উপাচার্যকে অনেক শিক্ষকই বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। সিন্ডিকেটেও বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি শুনতে চাইছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি উপাচার্য স্যারকে বলছিলাম, স্যার, আমি-আপনি একসময় এই ক্যাম্পাসে থাকব না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে। শিক্ষক নিয়োগ যদি এ রকম হয়, তাহলে আমরা কাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় রেখে যাচ্ছি, তা ভাবার দরকার।’

খুব ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক যখন তাদের কথা শুনেননি, যখন অনিয়ম হয়েছে তখন তারা কেন আদালতের (যদি ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ না থাকে) শরণাপন্ন হলেন না? প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার দর্শন বিভাগের শিক্ষক তোফায়েল আহমেদের নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা ও বাতিল করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গত বছরের ডিসেম্বরে নিয়োগ পেয়েছিলেন তোফায়েল। কিন্তু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী আবেদনের যোগ্যতা ছিল না তার। তো আদালতের পথ তো খোলাই ছিল। যে সব নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে বলে শিক্ষক নেতারা মনে করেছেন, সেগুলো ঠেকাতে তারা কেন আদালতে যাননি?

ঢাবি ভিসি
ঢাবি সিনেট ভবন

যাননি, কারণ তাদের মূল সমস্যা শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম না, সমস্যা আরেফিন সিদ্দিক। সাংবাদিকতার সূত্রে দেখেছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ সময় এভাবে হরেদরে নিয়োগ হয়। কিন্তু শিক্ষক নেতারা কিছুই বলেন না। যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন, তখন তারাই এভাবে তাদের অনুগতদের নিয়োগ দেয়। সেখানে মেধার চেয়েও দলীয় আনুগত্যই বেশি গুরুত্ব পায়। আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ফলাফল বিবেচনায় নিলে তারা মেধাবীও। এদের মধ্যে একজন নিয়োগ পেয়েছেন মহাজোট সরকারের আমলে। তার আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও তার বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। তখন তাকে বলা হয়েছিল, ‘বিএনপি কিংবা জামায়াত করব’ এরকম লিখিত দিলে তার নিয়োগ নিশ্চিত। বন্ধু আমার ওভাবে নিয়োগ পেতে চায়নি। তাই তাকে বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজনের (স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম) নিয়োগের বেলায় দেখেছি, তিনি আওয়ামী লীগের লোক এবং ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের বাইরে যাবেন না, এই নিশ্চয়তা যোগাড়ের জন্য তাকে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নিয়োগ কমিটির ক্ষমতাধর শিক্ষক নেতাদের কাছে একাধিক ফোন করাতে হয়েছে। অবেশেষে তার নিয়োগ হয়েছে।

কে মেধাবী, কে মেধাবী নয়; তা নির্ণয়ের মাপকাঠি কী? ভালো ফল করেও গুছিয়ে কথা বলতে না পারার জন্য যদি নিয়োগ না হয়, তো মেধাবী যাচাই করা হবে কোন নিক্তিতে? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাই এমন যে ভালো ফলধারীকেও এখানে মেধাবী বলার সুযোগ নেই। খুব খেয়াল করলে দেখা যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীল দলের শিক্ষকদের মধ্যে যে বিরোধ তার পুরোটাই ক্ষমতার দখল নিয়ে। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ‘উসিলা’ মাত্র। এর আগে সিনেটের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে নীল দলের শিক্ষকরা দুই ভাগ হয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করেছেন। শেষ পর্যন্ত তাদের বিরোধ থামাতে প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ভিসি প্যানেল নির্বাচন নিয়েও নাটক কম হলো না। সব-ই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়ার জন্য।শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের বিরোধের জের ধরে আদালতে রিট করা হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে আদালতে না গেলেও নিজেদের ক্ষমতার প্রশ্নে শিক্ষক নেতারা কিন্তু দৌড় দিয়ে আদালতে চলে গেছেন!

সবাই পদে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। যে শিক্ষক জিয়া পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি অবলীলায় নীল দলের প্যানেলে সিন্ডেকেটে ঢুকে যান। তখন কিন্তু কথা উঠে না। কারণ যে পক্ষ যেভাবে পারে নিজেদের দল ভারী করে। আহমদ ছফা তার ‘গাভী বিত্তান্ত’-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন বাস্তবের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। সম্প্রতি দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যপদে নাম লেখালেন। তো সেক্ষেত্রে তাদের নৈতিকতার মানদণ্ড কোথায় গেল? নীতির কথা না হয় বাদই দিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনীতি করেন কার স্বার্থে? তাদের এই দলাদলি, কোলাকুলি কিংবা বিভিন্ন রঙে ভাগ হয়ে দাড়িয়াবান্ধা খেলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কিভাবে উপকৃত হচ্ছে তা আমার বোঝে আসে না।

উপাচার্য বিরোধী শিক্ষকরাও আওয়ামী লীগপন্থী নীল দলের নেতা। তারা চাচ্ছেন আরেফিন সিদ্দিককে সরাতে। সরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে। মানে কি দাঁড়ালো? যে-ই লাউ সেই কদুই তো! এক আরেফিন সিদ্দিক যাবেন, আরেকজন তার জায়গায় বসবেন। তাতে তো সিস্টেমের কোনো হেরফের হচ্ছে না। যিনি বা যারা পরবর্তী উপাচার্য হওয়ার জন্য এই তোড়জোর করছেন, তাদের তো বলতে শুনলাম না যে আমি উপাচার্য হলে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মসহ যাবতীয় অনিয়মের পথ বন্ধ করবো। ’৭৩-এর অধ্যাদেশে বেশ ফাঁকফোকর আছে, সেগুলো বন্ধ করব। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াব। মানসম্মত গবেষণার ব্যবস্থা এবং সেগুলো নামকরা জার্নালে পাবলিশের ব্যবস্থা করব, শিক্ষার সার্বিক মান বৃদ্ধি করে র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উপরে নিয়ে আসব, শিক্ষার্থীদের জন্য আরো বৃত্তির ব্যবস্থা করব, তাদের আবাসন সংকট নিরসনে প্রয়োজনে নতুন হল করব, কিংবা পরিবহন ব্যবস্থায় আরো বেশি বাস যোগ করব, উল্টো পথে বাস চলাচল বন্ধ করব, ডাকসু নির্বাচন দিব।

তারা এগুলো বলেননি, কারণ এসব তাদের উদ্দেশ্য না। তাদের কেবল পদটা চাই, ক্ষমতা চাই, নিয়ন্ত্রণ চাই। সেজন্য আরো লেজুড়বৃত্তি করতেও তাদের কোনো সমস্যা নেই। তাই সিস্টেম নিয়ে সমস্যা না, তাদের সমস্যা ব্যক্তি নিয়ে। সিস্টেম জিইয়ে না রাখলে তারা শিক্ষার্থী নামক প্রজার সামনে সামন্ত প্রভুর মতো ভাব নেবেন কেমন করে? হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের ‘ফোর্ড’ চলে গেছে, ‘অক্স’ রয়ে গেছে। শিক্ষক নেতাদের সে কথা ভেবে দেখার অবসর কই?

৩.
ভিসি প্যানেল নির্বাচনের দিন দেখা গেল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধ্বস্তাধ্বস্তি হলো। বাম দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়েছিলেন ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে, ভিসি প্যানেল নির্বাচনের জন্য সিন্ডেকেটে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নির্বাচনের দাবি নিয়ে। কর্মসূচি আগেই ঘোষণা ছিল। সেদিন তারা দাবি নিয়ে সেখানে জড়ো হলে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে শিক্ষকদের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়।

এরশাদ স্বৈরাচার ছিলেন, কিন্তু সর্বশেষ তার আমলেই ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। তারপর প্রায় ২৭ বছরের গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে সরকার কিংবা কোনো ভিসি আর ওপথ মাড়াননি। একটি রিট আবদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ মার্চ হাইকার্ট নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন। ডাকসু নির্বাচন চেয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমাদ, সাধারণ সম্পাদক মোশতাক হোসাইন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী জাফরুল হাসান নাদিম এ রিট করেছিলেন।

১৯৯০ সালের ৬ জুন সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর গত ২৬ বছরে কোনো সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনই এ নির্বাচনের দাবি তোলেনি। এ অবস্থায় ভিসি প্যানেল নিবার্চনের দিন যারা সেখানে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে জড়ো হয়েছিলেন তাদের আচরণ দেখে আমার মনে হয়নি, দাবিটা তারা মনে থেকে করছেন। উল্টো মনে হয়েছে তারা উপাচার্যবিরোধী পক্ষের ‘বি টিম’ হিসেবে মাঠে নেমেছেন। আমার অুনমান ভুলও হতে পারে। কিন্তু সত্যিই ডাকসু নির্বাচন চাইলে তো এ বিষয়ে তারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো জনমত গঠন করতে পারতেন, এমনকি লাগাতার আন্দোলন করতে পারতেন। তারা কি তা করেছে? এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে কি হয় তার অতীত ইতিহাস তো আমাদের জানা আছে। তো, তারা কেন এ নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন না করে হুট করে সেখানে জড়ো হয়ে শিক্ষকদের মতোই অসহিষ্ণু আচরণ করলেন?

অপরাজেয় বাংলা

৪.
মাস কয়েক আগে (গত বছরও হতে পারে) ছাত্রলীগ একবার উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে মিছিল করলো, তার বাসভবন ঘেরাও করলো। তখনই আরেফিন সিদ্দিকের বুঝা উচিত ছিল বাতাস উল্টো দিকে বইতে শুরু করছে। কিন্তু তিনি হয়তো তা অনুধাবন করতে পারেননি। সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে যা হলো, তা থেকেও তার হাওয়ার গতি বোঝা দরকার ছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী মিমাংসা করে দেওয়ার পরও যখন তার বিরোধী সরকারপন্থী শিক্ষক নেতারা তেমন কোনো ছাড় দিলেন না, তখনই তার নিজের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল। তার বুঝা উচিত ছিল উপর থেকে আরো কেউ কলকাঠি নাড়ছে। কিন্তু তিনি তার অবস্থানেই থেকে গেলেন। এই যে থেকে গেলেন তা থেকে বুঝা যায় তিনি এখন একা হয়ে পড়েছেন, তার আশেপাশে এতদিন যারা ছিলেন তারা কেবল ক্ষমতার সুবিধাটুুকুই নিয়েছেন। এখন পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সটকে পড়েছেন, নয়তো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার সক্ষমতাই নেই তাদের।

৫৫ জন সিনেট মেম্বারের অনুপস্থিতিতে যেভাবে ভিসি প্যানেল নির্বাচন করা হলো, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। অত্যন্ত অনৈতিক কাজ হয়েছে। আদালত প্যানেল স্থগিত করেছেন।

পত্রিকাগুলো ‘অনিয়মের’ খনি তুলে আনছে। ফলে আরেফিন সিদ্দিক শিক্ষক হিসেবে যে ইমেজ সৃষ্টি করেছিলেন, ভিসি হিসেবে টানা বিশ্ববিদ্যালয় চালু রেখে কিংবা সেশন জট কমিয়ে, কোটি টাকার সিটিং অ্যালাউন্স না নিয়ে যে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাতে ফাটল ধরেছে। বিরোধীপক্ষ কতটা শক্তিশালী এখন তিনি হয়তো বুঝতে পারছেন। কিন্তু ততক্ষণে বোধ হয় তিনি আগের ইমেজে ফিরে যাওয়ার ট্রেনটা মিস করে ফেলেছেন। সরকারগুলো যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, আনুগত্যের ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ দেয়। কারণ যোগ্যতার মাপার কাঠি কই? তাই আনুগত্যই বড় মানদণ্ড। অনুগত কাউকে নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ জারি রাখতে চায় সব সরকার। এক্ষেত্রে সেই মানদণ্ডের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আরো কতজন সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছেন, আরেফিন সিদ্দিক কি সে খবর রেখেছেন?

আমার মতে সবচেয়ে ভালো হতো শিক্ষক রাজনীতি নামের এই নোংরামি থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিলে। তিনি যদি নিজে থেকেই আরেক মেয়াদে উপাচার্য প্রার্থী না হওয়ার কথা বলতেন, তাহলে তাকে আজকের এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হতো না। দুইবার তো উপাচার্য ছিলেন, আরেকবার কেন হতে হবে? এটা তো গণতান্ত্রিক আচরণ হলো না। কী লাভ হলো? আপনি তো ব্যবস্থা পাল্টাতে পারেননি। যারা আসবেন তারাও পাল্টাবেন না। তাহলে এত এত শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক হিসেবে আপনাদের সম্মানটা কোথায় থাকলো?

এনাফ ইজ এনাফ, এখন ’৭৩-এর অধ্যাদেশ সংশোধনের সময় এসেছে। না হলে এ অবস্থা চলতেই থাকবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হবে লুডু খেলার আসরে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)