চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

লাকী আখন্দ: গানের পাখির কলতান

চার দশক ধরে শহুরে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীর রোমান্টিসিজমের হাতে খড়ির মাধ্যম গান দুটি। পাশের বাড়ির জানালার শিক ধরে সলাজভীরু চোখে তাকানো কিশোরীটিকে প্রেম নিবেদনের সেরা পছন্দ, ‘এই নীল মনিহার, এই স্বর্ণালী দিনে, তোমায় দিয়ে গেলাম ’। নিবেদন সফল হওয়ার পর প্রেমিকাকে নিয়ে অজানাতে হারিয়ে যাওয়ার বিলাসি স্বপ্নটাও গলায় সুর হয়ে বাজে, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা শুধু দু’জনে, চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে’।

শুধু কি প্রেমিক,প্রেমিকা ! এদেশের হাজারো তরুণ ভিন্নধারার আধুনিক গানের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রথমবার গিটারের তারে আঙ্গুল ছোঁয়ায় এই দুটি গীতি কবিতাকে সঙ্গী করে। বাংলাদেশের আধুনিক গানের তালিকায় গান দুটির অবস্থান জনপ্রিয়তার এভারেস্টে। যে কোনো তারুণ্য অধ্যুষিত সঙ্গীতানুৃষ্ঠানে গান দুটি শুনতে চাইবার অনুরোধ আসবেই। সেই জলসায় গান দুটির গীতিকার এস.এম হেদায়েত কিংবা সুরস্রষ্টা শিল্পী ভ্রাতৃদ্বয় হ্যাপি কিংবা লাকি আখন্দ উপস্থিত না থাকুক ক্ষতি নেই। যারা উপস্থিত আছেন তাদের কাছেই গান শোনার আব্দার ।

কি আশ্চর্য, এই বায়নাও খুশি মনেই মেটান লাকি-হ্যাপিদের সতীর্থ কিংবা এ প্রজন্মের কেউ। এভাবেই অকাল মৃত্যুর কয়েক দশক পরেও ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’র মতো চিরসবুজ গানে অমর হয়ে আছেন গীতিকার এস.এম হেদায়েত ও দুই সুরস্রস্টার একজন হ্যাপি আখন্দ। স্বাধীন বাংলাদেশে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরেই নতুৃন স্বপ্নে, ভিন্ন মেজাজে যাত্রা শুরু করে সংস্কৃতি, সঙ্গীত,শিল্পকলা এবং ক্রীড়াঙ্গণ।

ক্রীড়া ক্ষেত্রে আবাহনী-শেখ কামাল, মঞ্চ-নাটকে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদ,পীযুষরা যদি হন নতুন যাত্রার নেতা, তাহলে ব্যান্ড সঙ্গীতে আজম খানের পাশপাশি ভিন্ন ধারা’র আধুনিক বাংলা গানে নতুন পরীক্ষা নীরিক্ষার অগ্রপথিক গায়ক-সুরকার লাকি আখন্দ। অসাধারণ প্রতিভাবান এই সুরস্রস্টার দু:সাহসী প্রচেষ্টা যে বিফলে যায়নি তা প্রমানিত ।

তথাকথিত জনপ্রিয়তা কিংবা বাণিজ্যিক সাফল্য’র জন্য বিদেশী সুরের ‘কপি-পেস্টের আয়েশী পথচলা নয়। প্রতিকূল শ্রোতাদের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে প্রথাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভিন্ন মেজাজের গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন । শ্রোতারা লুফে নিয়েছে ভিন্ন মেজাজের কথা আর সুরের অপূর্ব যুগলবন্দীকে। অ্যাকুয়েস্টিক ইন্সট্রুমেন্টের সঙ্গে।

পিয়ানো, কিবোর্ড, ড্রামস, স্যাক্সোফোন, হারমোনিকা, পারকশন’র অপূর্ব বন্ধন। পাশপাশি তবলা হারমোনিয়াম, বাঁশি, সেতারের মতো দেশীয় বাদ্যযন্ত্র পরিমিত ব্যবহারে দেশী সুরের সঙ্গে বিদেশী সুরের সংমিশ্রন লাকি আখন্দের সফল সুর সৃষ্টির রেসিপি। স্প্যানিশ সুরমুর্চ্ছনার অনুরাগী লাকি আখন্দ বাদ্যযন্ত্রের উদার ব্যবহার করেছেন, তবে তা কখেনো গানের বানীর আবেদনকে খর্ব করেনি।

লাকী আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ
হ্যাপী আখন্দ ও লাকী আখন্দ

বরং গানের কথার অলংকার হয়েছে সুর। সুরকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে এদেশে হামিং’র সফলতম ব্যবহারের সামনের সারির একজন লাকি আখন্দ। পাশপাশি পানির গ্লাস চিরুনি, দিয়াশলাই’র বক্স’র মতো নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী’র গায়ে টোকা দিয়ে অভিনব অথচ শ্রুতিমধুর ছন্দ সৃষ্টির কৌশল ‘শেকার’র সফল প্রয়োগের অগ্রপথিকও তিনি। ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা, ‘এই নীল মনিহার, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে, ‘তুমি কি দেখেছো পাহাড়ি ঝর্না,‘তুমি ডাকলে কাছে আসতাম সেতো জানতেই’ এমন সব গান শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরদিনের জন্য ঠাঁই নিয়েছে বানী ও আবহের সঙ্গে।

বানী ও সুরের বন্ধনকে বৈচিত্রময় ও সমৃদ্ধ করেছে হামিং ও শেকার। তার সুরারোপিত গানে ভিন্ন ধারার শ্রুতিমধূর বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয়েছে অনিবার্যতায়, তবে গানের বানী হারিয়ে যায়নি সুরের আগ্রাসনে। গানের বানীকে গুরুত্ব দিয়ে আবহ ও পারিপার্শ্বিকতা তৈরী করেছে সুর। অভিন্ন সুর অথচ ভিন্ন ভিন্ন সংগীতায়োজনে গাওয়া হয়েছে একই গান। এই নিরীক্ষা মনজয় করেছে সবার, শ্রোতারা পেয়েছেন নতুনত্বের স্বাদ।

‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটি সুরকার লাকি আখন্দ যেভাবে গেয়েছেন সেই একই গান কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠে ধরা দিয়েছে ভিন্ন অ্যারেঞ্জমেন্টে। দু’ভাবেই পরিবেশিত গানটি শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরদিনের জন্য গেথে আছে। একই ঘটনা ‘মামুনিয়া ও বিড়ালের ছানা’ গানটিতে। সুরকার নিজের কণ্ঠে গেয়েছেন যেই অ্যারেঞ্জমেন্টে, সুর অবিকৃত রেখে গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদকে দিয়ে গানটি গাইয়েছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। সামিনা নবী’র কণ্ঠে কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে, জেমসের গলায় লিখতে পারিনা কোন গান আজ তুমি ছাড়া, আইয়ুব বাচ্চু’র, কি করে বললে তুমি,লাকি আখন্দের নিজের কণ্ঠে আমায় ডেকোনা ফেরানো যাবেনা কিংবা ছোটভাই হ্যাপি আখন্দ’কে নিয়ে দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে গান লিখেছি’ বাংলাদেশের আধুনিক গানের ইতিহাসে ভিন্ন এক ধারার মাইলফলক হয়ে আছে। %e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%86%e0%a6%96%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%a7

ফোক ফিউশনের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের মেলবন্ধন তার সৃষ্টির মূল অবলম্বন। বিশেষ করে স্প্যানিশ সুরমুর্চ্ছনার প্রতি লাকি আখন্দের পক্ষপাতিত্ব চোখে পড়ার মতো। তবে পাশ্চাত্য ও আধুনিক সুরের নিরবিচ্ছিন্ন ব্যবহারে আটকে থাকেনি লাকি আখন্দের সংগীত প্রতিভা। বরং দেশীয় ধ্রুপদী ও ঠুমরি’র সুরে তৈরী করেছেন অন্তত: দুটি গান যা মন কেড়েছে সংগীতবোদ্ধার। কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কথায় গজল ও ক্ল্যাাসিক্যাল সুরের উপর তৈরী করা ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায়’ গানটি নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর কণ্ঠে যে সুরে তুলে দিয়েছেন তাতে প্রমান হয়, লাকি আখন্দ জন্মেছেন কালোত্তীর্ণ সৃষ্টির নেশায়।

ঠুমরি’র উপর ছেলের কোনো কাজ নেই, এমন অনুযোগ ছিলো মা নুরজাহান বেগমের। মায়ের ইচ্ছায় নিজেরই লেখা,‘ ভুলতে পারিনি তোমায়, তুমি কে বলোনা’ গীতিকবিতাটিকে ঠুমরি ধাচে সুর করে নিজেই গাইলেন লাকি । চমৎকার সুরারোপের জন্য মুগ্ধ হয়ে মা নুরজাহান বেগম পুরস্কার হিসাবে ছেলের হাতে তুলে দেন ১০ হাজার টাকা।

পাশপাশি সেরা সুর সৃষ্টির অকৃপণ তারিফ। ভিন্ন ধারার সুরে নিরিক্ষাধর্মী সংগীতায়োজনে আগ্রহী বলে লাকি আখন্দ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন এস.এম হেদায়েত, গোলাম মেরশেদ কিংবা কায়সার আহমেদ চৌধুরীর মতো ভিন্নধারার গীতিকারদের সঙ্গে কাজ করতে। এরমধ্যে কায়সার আহমেদ চৌধুরীর কলমে উঠে আসা ঝরঝরে সহজবোধ্য আধুনিক রোমান্টিক গীতিকবিতা লাকি’র সুরে পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা আর অমরত্ব। এদেশের বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাসে কায়সার আহমেদ চৌধুরী ও লাকি আখন্দের বোঝাপড়া ও সৃষ্টিশীলতার যুগলবন্দী হয়ে আছে শ্রোতা পছন্দের সেরা রসায়ন।

১৯৫৫ সালের ১৮ জুন পুরোনো ঢাকার পাতলা খান লেনের এক সংগীতানুরাগি পরিবারে জন্ম লাকি আখন্দের । তিন ভাই জলি, হ্যাপি ও লাকি’র সংগীতের প্রতি অনুরাগ পারিবারিকভাবেই । পাঁচ বছর বয়সে বাবা আব্দুল আলি আখন্দের হাত ধরে সংগীত শিক্ষায় হাতেখড়ি তার। ১৩ বছর বয়সে আধুনিক সংগীতে পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের পুরস্কার জয়। ১৪ বছর বয়সে এইচএমভি পাকিস্তান কোম্পানির সুরকার হিসাবে লাকি আখন্দের নাম তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৭১ এ ১৬ বছর বয়সে এইচএমভি ইন্ডিয়ায় সুরকার হিসাবে যুক্ত হন তিনি।

সে বছরই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবি বেতার কেন্দ্রে’র সংগীত শিল্পী’র ভূমিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন এই কণ্ঠযোদ্ধা। ডিসেম্বরে বিজয়ের পর দেশে ফিরে বাংলাদেশ বেতার এ যোগ দেন। ডিরেক্টর মিউজিক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন চাকরি জীবনের শেষ পর্বে । ১৯৮৭ সালে ছোটভাই হ্যাপি আখন্দের অকাল মৃত্যু লাকি’র সংগীতজীবনকেও থমকে দেয়। ভাইয়ের চিরবিদায়ের পরই স্বেচ্ছা নির্বাসন যান। ১৯৯৯ সালে আবারো ফিরেছেন। তার সংগীত পরিচালনায় একমাত্র বাংলা চলচিত্র সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকি পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’ মুক্তি পায় ১৯৮৮ সালে। %e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%86%e0%a6%96%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6

ছোটভাই হ্যাপি আখন্দের কণ্ঠ ও সংগীতায়োজনে রইসুল ইসলাম আসাদ ও সূর্বনা মুস্তাফার অভিনয় ও লিপে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটির মনকাড়া সুর ও দূর্দান্ত চিত্রায়ন ছিলো ঘুড্ডি চলচিত্রের অন্যতম আকর্ষণ। তবে বাণিজ্যিক অসাফল্য কিংবা শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসাবে জাতীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় লাকি আখন্দের চলচিত্র-সুরকারের পর্ব সেখানেই ইতি। তার মতো একজন সৃজনশীল সুরকারকে পেয়েও হারানো বাংলাদেশের চলচিত্র শিল্পের জন্য বড় বেদনার।

১৯৯৮ সালে ভারতীয় ভিন্নধারা’র বাংলাগানের জনপ্রিয় গায়ক অঞ্জন দত্ত ঢাকায় স্টেজ শো করেন জাতীয় যাদুঘরে। লাকির সঙ্গে অঞ্জনের পরিচয় সেই মঞ্চে। কয়েকটি গানও গাইলেন একসাথে। তখন পর্যন্ত অঞ্জন দত্তের কোনো গান শোনেননি লাকি। সেই অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণ করে ওপার বাংলার অঞ্জন দত্ত’র অকপট স্বীকারোক্তি, কোন গায়কের সঙ্গে মঞ্চে গান গাইতে গিয়ে এত তৃপ্তি তিনি পাননি। পরে লাকি’র সঙ্গে একমঞ্চে গান গাইবার স্মৃুতি নিয়ে অঞ্জন দত্ত একটি গান বাঁধেন।