চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রজনীগন্ধার গন্ধে নবীন বরণ বনাম ‘র‍্যাগিং’

গত পরশু আমার এক সিনিয়র সহকর্মী জিজ্ঞেস করলেন –“ এই যে গণমাধ্যমের শিক্ষক, কী খবর?” আমি হেসে উত্তর দিলাম, স্যার, গণমাধ্যমের উচিত এখন উল্টো আমাদের কে নিয়ে অধ্যয়ন করা। কিভাবে যে বিভাগ চলছে, তা ভাবলে নিজেরই এখন অবিশ্বাস্য ঠেকে। ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর আমরা চারজন শিক্ষক বিভাগে যোগদান করেছিলাম। ব্যাচ ছিল একটা; এখন ২০১৬ সাল, ব্যাচ হয়েছে মোট ৫ টা। শিক্ষক আমরা সেই চারজনই আছি। আমরা যেন সোনার ডিম পাড়া সেই হাঁস, যার পেট কেটে সব ডিম বের করে নিতে চেয়েছিল মালিক। পরিণতিতে হাঁসটিকে মরতে হয়েছিল।

আল্লাহ তাআলা’র কাছে শোকরিয়া, যে ভাবেই হোক, বিভাগ চালু আছে। স্টুডেন্টরা আমাদের ছেড়ে চলে যায়নি; ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে, পরীক্ষার রেজাল্টও বের হচ্ছে। শিক্ষকদের বসার জায়গা নেই, বিভাগের নিজস্ব কোনো ক্লাসরুম নেই। প্রথম ব্যাচ প্রায় এক বছর ক্লাস করেছে দুপুরের পর।ধন্যবাদ সে সব বিভাগকে যারা তাঁদের ক্লাসরুম আমাদের সাথে শেয়ার করে চলেছেন।‘সবুরে মেওয়া ফলে’- এই কথা যে সত্য তাও আমরা অবলোকন করতে যাচ্ছি। বর্তমান উপাচার্য মহোদয় আমাদের বিভাগের নিজস্ব জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নতুন কলা ভবনের চার তলায় আমাদের বিভাগের নিজস্ব অফিস, ক্লাসরুম নির্মাণের কাজ চলছে। দয়া করে নতুন কিছু শিক্ষকও যদি ভিসি মহোদয় ব্যবস্থা করে দেন, তাহলে আমরা বেঁচে যাই, বিভাগটিও বেঁচে যায় ।

সেই কবে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি হয়েছে, অর্ধ বছর চলে গেছে, শিক্ষক নিয়োগে ভাইভা ডাকা হচ্ছেনা। মাঝখানে একবার যতটা আকস্মিক ভাবে ভাইভার তারিখ জানানো হয়েছিল, তাঁর চেয়েও আকস্মিক ভাবে সে তারিখ স্থগিত করা হয়। বিশেষ সেই কারণ জানা যায়নি। বিভাগীয় এমনতর অনাকাঙ্ক্ষিত বাতাবরণে গত ১২ মার্চ ক্যাম্পাসে এসেছে নতুন ছাত্রছাত্রী, ৪৫ তম আবর্তন।

নানামুখী অনিশ্চয়তার মাঝেও আমরা খুশি খুশি চেহারা ধরে রেখেছি, নয়ারহাঁটের মিষ্টি আর নবীনগর থেকে আনা কেক খেয়ে, খাইয়ে, রজনীগন্ধার গন্ধে নবীনদের বরণ করেছি। চটপটে নবীনরাও দারুণ সব কথা বলে, নিজেদের বুদ্ধিমত্তার আগাম জানান দিয়েছে। সুন্দর আগামীর সন্দেশ পেয়ে যখন বিকেলের সবুজ বাসে যাদুর শহর ঢাকায় ফিরলাম, তখন কয়েকটি ফোন পেয়ে বুঝলাম নবীনের সকাল যত রঙ্গিন ছিল, বিকেল ততটা নয়।

আজ রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে রঙ হারাবে মন, ধীরে ধীরে সব রং উড়ে গিয়ে মনোজগতের দখল নিবে বিরক্তি, আতংক আর ক্ষোভ। সে আতংক কখনো যথা, কখনো অযথা। আমি ‘র‍্যাগিং’ এর কথা বলছি। পড়াশোনা শেষ করে বের হয়ে যাওয়ার আগে রং মেখে সঙ সেজে বাদ্যের তালে তালে নেচে গেয়ে র‌্যাগ ডে পালন করা, আর র‍্যাগিং দেয়া/খাওয়া এক জিনিস না। যার নসীবে র‍্যাগ আছে বা যিনি এই বিশেষ কর্মটি সম্পাদন করেন, কেবল তারাই বলতে পারবেন ‘ র‍্যাগ’ কী জিনিস!

ম্যাচের কাঠি কিংবা কয়েন দিয়ে রুমের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মাপানো, শীতের রাতে ঠাণ্ডা পানিতে নামানো কিংবা অন্যদের সামনে প্রায় নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে রাখা, প্রায় সারারাত কান ধরে বড় ভাইদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদি অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনাও ঘটে বলে শোনা যায়।

যা শুনি তা যে পুরোটা মিথ্যা নয়, তার প্রমাণ ইচ্ছে করলেই পাওয়া যায়। নবীন ছাত্র যখন তার টিচারকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে ফেলে, তখন বুঝতে অসুবিধে হয়না যে এই ছাত্র টিচারের কাছে আসার আগে কী পরিমাণ সালাম দিয়ে, ভাইদের হাতে কী বিপুল তালিম নিয়ে এসেছে!

অচেনা কাউকে দেখলেই ভয়ে ভয়ে সালাম দিতে দিতে, যেখানে সেখানে ‘ভাই’ দের খপ্পরে পড়ে সবক নিতে নিতে এই নবীনদের মনে ও মগজে যে প্রত্যয়টি বার বার মহা দাপটে ফিরে আসে, সেটি হল “ভাই”। বড় “আপু”দের একটা অংশও নাকি নানা কায়দায় নবীন ছাত্রীদেরকে ক্যাম্পাসের কায়দা-কানুন শেখাতে গিয়ে র‍্যাগিং এর কাজটি সম্পাদন করেন বলে শোনা যায়।

বিভিন্ন বিভাগের প্রথম বর্ষের রেজাল্ট বিশ্লেষণ করলেও প্রথম বর্ষের ছেলেদের উপর কি পরিমাণ মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন হয় তার আলামত পাওয়া যাবে। আমার ব্যাক্তিগত অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের প্রথম বর্ষ থেকেই ভালো রেজাল্ট করার হার অনেক বেশি।

তার কারণ, প্রথম বর্ষে মেয়েরা ক্যাম্পাসে ছেলেদের তুলনায় ভালো পরিবেশে থাকে এবং তুলনামূলকভাবে অনেক কম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। নবীন মেয়েদের উপর র‍্যাগিং হয়না তা না। তবে ছেলেদের র‍্যাগ যেমন ভয়াবহ আর শক্ত প্রকৃতির, মেয়েদের র‍্যাগ ততটা নয়। বিশেষ ধরনের।

যেমন একটা ঘটনায়, হলের বড় আপুরা নবীন এক ছাত্রীর মোবাইল ফোন নাম্বার ক্যাম্পাসে তার পরিচিত ছেলেদেরকে দিয়ে দিয়েছিল। প্রতি মিনিটেই মেয়েটাকে কেউ না কেউ ফোন দিয়ে বলত ক্যাম্পাসের এখানে আস, ওখানে যাও। মেয়েটি এক পর্যায়ে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়লে তার অভিভাবকরা এসে তাঁকে নিয়ে যায়।

গতবার তো ক্যাম্পাসের একটি হলে, র‍্যাগ দিতে গিয়ে ৪৪ ব্যাচের এক ছেলের একটা চোখ থেকে রক্ত বের করে ফেলে তথাকথিত বড় ভাইয়েরা, আরেকটা ছেলের হাঁটুতে মারাত্মক জখম করা হয়। দৈনিক কালের কণ্ঠে এ নিয়ে বিরাট রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। তবে হল প্রশাসন এই অপরাধীদের বিচার করেছিল কিনা, তা আর জানা যায়নি। এবার তো মনে হচ্ছে, ‘র‍্যাগিং’ এবং র‍্যাগিং প্রতিরোধে শিক্ষক সমাজ ও প্রশাসনের কর্মতৎপরতা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

কেন্দ্রীয় প্রশাসন যা কিছু করা সম্ভব, করছেন। সব দায়িত্বশীল পক্ষ নিয়ে সভার পর সভা করছেন। মাইকিং হচ্ছে। এইতো সেদিন একটি হলে র‍্যাগিং এর শিকার এক ছেলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মাঝরাতে হাসপাতালে এনে চিকিৎসা দিতে হয়েছে। আধুনিক এলোপ্যাথির ডাক্তার হয়ত তার শরীর যন্ত্র ঠিক করতে ওষুধ লিখেছেন, কিন্তু তার ভেঙ্গে যাওয়া মন মেরামত করবে কে?

সচেতন শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে মানব বন্ধন করেছেন। প্রশাসনের তদারিকি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। প্রশ্ন হল, ‘প্রশাসন’ কে? প্রশাসন মানে কি শুধু ভাইস চ্যান্সেলর আর তাঁর প্রক্টরিয়াল টিম? প্রতিটি হলের প্রভোস্ট রয়েছেন, ৭/৮ জন করে আবাসিক, সহকারী আবাসিক শিক্ষক রয়েছেন।কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বহর তো আছেই। বিস্তীর্ণ ক্যাম্পাসের আনাচে, কানাচে প্রক্টরিয়াল টিম যত খানি সক্রিয় থাকে, হল প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ কি সেই পরিমাণ সক্রিয় থাকেন হলের ভেতরকার ঘটনা বলীতে? আর নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে অস্বীকার করার প্রবণতা তো আছেই। সবাই জানে, দেখে যে র্যা গ হচ্ছে, কিন্তু দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যাক্তি হয়ত বলছেন, না র‍্যাগিং হচ্ছেনা।

নিজের কাছে থেকে পালিয়ে বেরানোর প্রবণতা কিংবা শুধুমাত্র প্রতাপশালী ছাত্র নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে গদি ঠিক রাখার আপ্রাণ প্রয়াস চালানোর প্রবণতা থেকেও আমাদের বের হয়ে আসেতে হবে। বিভাগের অভ্যন্তরে, বা জনাকীর্ণ জায়গা গুলোতে হয়ত শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের তৎপরতায় র‍্যাগ প্রদানকারীরা কিছুটা দমে থাকে, কিন্তু “ময়না দ্বীপ” এ যখন নবীনদের নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমরা তার খবর পাই কি?কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা দরকার। যেমন র‍্যাগিং কি গণহারে হয়? বড় ভাই/আপুদের সবাই কি র‍্যাগ দেয়? নবীন শিক্ষার্থীদের সবাই কি র্যাগগিং এর শিকার হয়? কারা দেয়, কেন দেয় অর্থাৎ এর মনোবৈজ্ঞানিক কারণ কী? এর সমাধান কিভাবে হতে পারে? প্রশাসনের (শুধু এই বর্তমান প্রশাসন নয়) ঐতিহাসিক কোনো দায় আছে কিনা?

ইত্যাদি জিজ্ঞাসার সঠিক উত্তর পাওয়া গেলে আমার মনে হয়, অসুস্থ র‍্যাগিং প্রদান বন্ধ করা যাবে।জাহাঙ্গীরনগরে একেবারেই র‍্যাগিং হয়না কিংবা এখানে সিনিয়র ব্যাচের সব ছাত্রছাত্রীই নবীনদের ‘র‍্যাগ’ দেয় বা সব নবীনই বাজে ভাবে র‍্যাগিং এর শিকার হোন—এই রকম ধারণার একটাও সঠিক নয়। সবাই যেমন ‘র‍্যাগ’ দেয়না, সবাই তেমন এর শিকারও হয়না।

প্রতিটি বিভাগে হাতে গোনা কিছু ছেলে/মেয়ে আছে যারা অতি উৎসাহী ও অতি আগ্রাসি ভুমিকা পালন করে। এরাই নেতৃত্ব দেয়। বিভাগে শিক্ষকদের, মূল ক্যাম্পাসে প্রক্টরিয়াল টিমের তাড়া খেয়ে নবীনদের ময়না দ্বীপে নিয়ে যায়, রাতের অপেক্ষায় থাকে; হলে, বটতলায়, টারজান পয়েণ্টে যখন যেখানে, যেভাবে পারে কাজ সম্পাদন করে ফেলে। এরকম একটি মহা বিতর্কিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তাহলে এরা করে কেন? আমার মনে হয়, অবদমন থেকে মুক্তির জন্য। পুরো একটা বছর মানসিক ও শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হয়ে, নানা সময়ে বিচার চেয়ে, বিচার না পেয়ে, উল্টো কারো কারো কাছ থেকে “হজম” করে ফেলার সবক অথবা ধমক খেয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের দল মনের ভেতর ভয়ানক রাগ পুষে রাখে। তার সাথে যা হয়েছে, নতুন আসা ছেলে মেয়েদের সাথেও সে এমন কিছুই করতে চায়। এভাবেই গত কয়েক বছর হয়ত অতীতের ‘মিষ্টি’ র‍্যাগিং সাম্প্রতিক কালে ভয়ঙ্কর রুপ ধারন করেছে।

সবগুলো ঘটনা জেনে, প্রকৃত দোষীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে পারলে; পাশাপাশি র‍্যাগিং এর শিকার হওয়া শিক্ষার্থীর মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির যথাযথ মেরামতের ব্যবস্থা করতে পারলে আমার বিশ্বাস এই বিশেষ অপরাধ জাবি’র সবুজ, স্নিগ্ধ বুকে থাকবে না।

মুশকিল হল, মুষ্টিমেয় দুর্বৃত্তরা সব নবীনের মনে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় যে এরা নিজের নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখের ব্যথা ও কষ্ট সহ্য করবে, কিন্তু অভিযোগ নামা লিখতে অস্বীকার করবে। ফলে খুঁটিনাটি সব ঘটনার খবর প্রশাসনের রাখতে হবে। কঠিন কাজ, তবে অসম্ভব নয়। সব শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, সিনিয়র স্টুডেন্ট এবং নবীনরা সবাই যদি যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে আর প্রশাসন যদি শতভাগ আন্তরিকতা আর সক্রিয়তা নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে অবশ্যই “র‍্যাগিং” নামের অভিশাপ থাকবেনা।

একটা ব্যাচ কে যদি আমরা “র‍্যাগিং মুক্ত” রাখতে পারি, তাহলে পরের ব্যাচ আর এই ভয়াল তৎপরতার শিকার হবেনা, এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। আরেকটা প্রশ্ন সবার জন্য উন্মুক্ত। জাহাঙ্গীরনগরে কি শুধু এই মুষ্টিমেয় কিছু ছেলে-মেয়েই ভিলেন?না আরও অন্যান্য বিষয়ে বা প্রক্রিয়ায়ও ভিলেন আছে?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)