চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘প্রেস্টিজ ইস্যুতে’ অবহেলিত রাজধানীর সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলো

রাজধানীর স্কুলগুলোতে ভর্তির মৌসুম আসন্ন। এ মৌসুম আসলেই যেন ঘুম হারাম হয়ে যায় অভিভাবকদের। ‘কাঙ্ক্ষিত’ স্কুলগুলোতে যে করেই হোক ভর্তি করাতে কোন চেষ্টারই কমতি রাখেন না তারা। স্কুল শুরুর আগেই ছোট্ট শিশুর পরিচয় ঘটে যায় প্রাইভেট-কোচিংয়ের সঙ্গে। ঠিক মত হাঁটতে শেখার আগে তাদেরকে স্কুল থেকে স্কুলে ছুটতে হয় ভর্তি পরীক্ষা দিতে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, ‘প্রেস্টিজ বাঁচাতে’ শিশুদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘যুদ্ধের ময়দানে’।

কিছু নামি বেসরকারি স্কুলে ভর্তির জন্য রীতিমত যুদ্ধ হলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো থাকার পরও শিক্ষার্থী পাচ্ছে না সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলো। এখানে যারা পড়তে আসছে তাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত এবং খেটে খাওয়া মানুষের সন্তান।

রাজধানীর বাবুপুরা কাটাবন মোড়ের কাছে অবস্থিত শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. আমিনউদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মনোরম একতলা ভবনের সামনে রয়েছে খোলা চত্বর, শিশুদের খেলার জায়গা ও বাগান। এত ভালো পরিবেশ সত্ত্বেও অভিভাবকদের দৃষ্টি টানতে পারছে না স্কুলটি। শিক্ষার্থীদের আকৃ্ষ্ট করতে মূল ফটকের বাইরে স্কুলের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বিজ্ঞাপনও দিতে দেখা যায়। রাজধানীতে এরকম ভালো পরিবেশের বেশকিছু সরকারি প্রাইমারি স্কুল থাকলেও সেখানকার শিক্ষকরা জানান, এসব স্কুল টানতে পারছে না মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদেরকেও।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করা অধ্যাপকরা বলছেন, মূলত প্রেস্টিজ ইস্যুতেই অভিভাবকরা এসব স্কুলে তাদের সন্তানদের পাঠাতে চান না। তাছাড়া সরকার এবং কর্তৃপক্ষের এ স্কুলগুলোর প্র্রতি মনোযোগে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সংসদে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীতে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা ৩৩৮টি।

মন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী এ সব স্কুলে শিক্ষকরা ভাল বলে লেখাপড়ার মানও ভাল। সরকার শিক্ষার মান উন্নয়নে ১০ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

কিন্ডারগার্টেনের সঙ্গে তুলনা করে তিনি আরও বলেন, ‘রাজধানীতে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ১৪ হাজারের কাছাকাছি, তবে ৩৩৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হলেও লেখাপড়ার মান ভালো নয়। অভিভাবকদের আগ্রহের কারণে সন্তানরা এ সব স্কুলে পড়তে যায়।

শিক্ষকদের মান ভাল অবকাঠামো ভাল তারপরেও কেন এসব স্কুলে প্রতি অভিভাবকদের আগ্রহ নেই?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. দেলোয়ার হোসেনের বক্তব্যে এর জবাব পাওয়া যায়। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে সরকার এবং পরিচালনা কমিটির মনোযোগের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। মানসম্মত পড়ালেখার অভাব থাকায় অভিভাবকেরা এসব স্কুলে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তাছাড়া শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিতের ব্যাপারেও গুরুত্ব নেই।

‘‘প্রশিক্ষণ থাকলেও শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগী নয়। তারা চাকরি করতে হয় বলে দায়সারা ভাবে চাকরি করেন। শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশ ও শিক্ষা নিশ্চিতের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম,’’ জানান তিনি।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করা এবং একটা সময়ে হাইস্কুলে শিক্ষকতা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক শেখ মনির উদ্দিন দেখছেন আরও কিছু কারণ। তার মতে মূলত প্রেস্টিজ ইস্যুর কারণে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের প্রাইমারি স্কুলে পাঠান না।

চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: আমাদের অভিভাবকদের মনে একটা ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে গরিবের সন্তানেরা পড়াশোনা করে। তাছাড়া কে কত বেশি বেতন দিয়ে তার সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছে এটাও তাদের জন্য একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে উঠেছে। ফলে তারা কথিত নামী স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করাতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

সরকারি স্কুলগুলোতে আগ্রহহীনতার জন্য যথেষ্ট প্রচার-প্রচারণা অভাবকেও অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন: বেসরকারি স্কুলগুলো যেভাবে প্রচার-প্রচারণা চালায় সেখানে প্রক্রিয়াগত জটিলতা বা বিভিন্ন কারনে সরকারি স্কুলগুলোতে সেটা হয় না। ফলে অভিভাবকেরা আগ্রহ পান না।

দেশের পড়ালেখায়  গ্রাম বা মফস্বলের প্রাইমারি স্কুলগুলো প্রধান ভুমিকা রাখলেও সরকারের যথাযথ নজরদারির অভাব এবং কর্তৃপক্ষের অবহেলায় শহরের স্কুলগুলো কোন ভুমিকাই রাখতে পারছে না। পক্ষান্তরে কথিত নামী স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করাতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের রীতিমত যুদ্ধে নামিয়ে দিচ্ছেন’’, বলেন অধ্যাপক মনির উদ্দিন।

স্কুলগুলোকে যথেষ্ট পরিচর্যা করে শিক্ষার মান বৃদ্ধির দিকে নজর দিলে কথিত নামি স্কুলগুলোতে ভর্তির চাপ অনেকটা কমবে। ফলে শিশুরাও অনেকটা চাপ মুক্ত থাকতে পারবে বলে মনে করেন এ অধ্যাপক।