চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

পদত্যাগ করলেন জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট মুগাবে

জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে পদত্যাগ করেছেন বলে দেশটির স্পিকার জ্যাকব মুদেন্দা জানিয়েছেন। ব্যক্তিগত ইচ্ছায় এক পত্রের মাধ্যমে মুগাবে পদত্যাগ করেছেন বলে রয়টার্স ও বিবিসি জানিয়েছে।

দেশটির সংসদ সদস্যরা মুগাবের বিরুদ্ধে অভিশংসনের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করছিলেন এর মধ্যেই বিস্ময়কর এই ঘোষণা এলো। গত সপ্তাহে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে তাকে গৃহবন্দি করে। এরপরেও তিনি পদত্যাগে রাজি হননি।

১৯৮০ সালে জিম্বাবুয়ে স্বাধীন হবার পর থেকে তিনি দেশটির ক্ষমতায় রয়েছেন। ৩৭ বছর পর পদত্যাগ করলেন তিনি। বুধবার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকেই চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রতিটি দিন যাচ্ছিলো জিম্বাবুয়ের। করণীয় নির্ধারণে গত রোববার বৈঠকে বসেন ক্ষমতাসীন জানু-পিএফ পার্টি।

বৈঠকে রবার্ট মুগাবেকে দলীয় প্রধানের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হন মুগাবের হাতে বহিষ্কৃত নেতা ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নাঙ্গাগওয়া। এসময় মুগাবের স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকেও পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারপর প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে মুগাবেকে গতকাল সোমবার দুপুর পর্যন্ত সময়সীমা বেধে দেয়া হয়েছিলো। তা না হলে তাকে অভিশংসনের মুখোমুখি হতে হবে বলেও এসময় জানিয়ে দেয়া হয়।

এর পরপরই টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে মুগাবে পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন: ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন পার্টির কংগ্রেসের আগ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়বেন না তিনি। বরং পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার বদলে উল্টো আসন্ন কংগ্রেসে নিজের জানু-পিএফ পার্টিকে নেতৃত্ব দেয়ার জিম্বাবুয়ে-রবার্ট মুগাবে-জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনীআকাঙ্ক্ষার কথা জানান এই গৃহবন্দী প্রেসিডেন্ট।

সরাসরি সম্প্রচারিত ওই ভাষণে মুগাবে বলেন: এখন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যে কংগ্রেস আছে আমি সেখানে সভাপতিত্ব করব। এটা অবশ্যই কারও দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া উচিত নয়। জনগণের চোখে এর ফলাফলকে আপোষের মতো করে দেখানো ঠিক হবে না।

কিন্তু নিজ দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরও পদত্যাগ না করার ঘোষণায় মুগাবের প্রাক্তণ মিত্ররা এর নিন্দা জানান। তাদের আশঙ্কা, এ ঘোষণার প্রতিবাদে বিরোধীরা আবারও রাজপথে নেমে আসবে।

ইতেমধ্যে জিম্বাবুয়ের সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে উল্লাস করছেন। রাজধানী হারারেতে রাস্তায় নেমেছে অসংখ্য মানুষ। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ছবি তুলছেন। অনেকের হাতে রয়েছে নানা ধরনের পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড। যাতে মুগাবের পদত্যাগের দাবি সম্বলিত নানা কথা লেখা রয়েছে।

রবার্ট গ্যাব্রিয়েল মুগাবের জন্ম হয় ১৯২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানী হারারের পশ্চিমে অবস্থিত কুটামায়। ফোর্ট হেয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রি নেয়ার পরও লন্ডন ইউনিভর্সিটিসহ আরও কয়েকটি দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি।

লেখাপড়া শেষে তৎকালীন সাউদার্ন রোডেশিয়া এবং প্রতিবেশি দেশগুলোর বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন মুগাবে। এর মাঝেই ঢোকেন রাজনীতিতে। ১৯৬০ সালে মুগাবে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। তার পরের বছরই তাকে জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান পিপল’স ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। দলটি পরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

১৯৬২ সালে তাকে রাজনৈতিক কারণে আটক করা হয়। আর এর পরের বছরই তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (জানু) নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে এর মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৬৪ সালে মুগাবেকে আবারও বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়। তবে ১৯৭৪ সালে অবশেষে তিনি জেল ভেঙে পালিয়ে মোজাম্বিক চলে যান। সেখান থেকেই ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সাউদার্ন রোডেশিয়ার স্মিথ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন রবার্ট মুগাবে।

রবার্ট মুগাবে ১৯৮০ সালে জিম্বাবুয়ের সরকারপ্রধান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এর আগ পর্যন্ত সাউদার্ন রোডেশিয়া (স্বাধীনতাপূর্ব জিম্বাবুয়ের নাম) ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি উপনিবেশ। অঞ্চলটির শ্বেতাঙ্গ শাসক ইয়েন স্মিথ ও তার শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে টানা ১৪ বছর বিদ্রোহ ও লড়াই চালিয়ে জয় পান মুগাবে।

জিম্বাবুয়ে-রবার্ট মুগাবে-মুগাবের অভিসংশন
স্ত্রীকে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে

লর্ড ক্রিস্টোফার সোমসের মাধ্যমে আয়রন লেডি বলে খ্যাত নবনির্বাচিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ১৯৭৯ সালে ইয়েন স্মিথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বন্ধ করতে একটা সমঝোতা চুক্তি করানোর চেষ্টা করেন। সবাই অবাক হয়ে দেখল, মাক্সবাদের মতাদর্শে চলা কট্টর স্বাধীনতাকামী, নিজের আদর্শে দৃঢ় রবার্ট মুগাবে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকার শর্তসহ স্বাধীন জিম্বাবুয়ে নিয়ে এলেন। ’৮৮ থেকে তিনি হলেন জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীন জিম্বাবুয়ের দায়িত্ব নেয়ার সময়েই মুগাবে কথা দেন রাজতন্ত্র ও ঔপনিবেশিকতার শাসনে থাকা অঞ্চলটিকে গণতন্ত্রের আওতায় আনার। এমনকি বিদেশি বিনিয়োগ আনতে উদগ্রীব নতুন রাষ্ট্রের নবগঠিত সরকার ঘোষণা করল, শ্বেতাঙ্গ কৃষকরা নতুন জিম্বাবুয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

রবার্ট মুগাবে-মুগাবেকে শুভেচ্ছা দূত নিয়োগ-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের কিছু সময় পর থেকেই পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে যেতে থাকে। মুগাবে যাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন বা যাদের শত্রু মনে করতেন তাদেরকে সাফ করে ফেলা হতে থাকে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর দায়িত্ব নেয় স্মিথ শাসনের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে মুগাবের পাশে থাকা বিশ্বস্ত ‘অভিজ্ঞ’ লোকজন।

এই বিশ্বস্ত সঙ্গীরা জিম্বাবুয়ের শেতাঙ্গ কৃষকদের ঘরবাড়ি ও জমিতে প্রায়ই হামলা ও লুটপাট চালাত, জমি কেড়ে নিত, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত, এমনকি কৃষকদের হত্যাও করত।

২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর রবার্ট মুগাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রের প্রতি ‘চরম অবজ্ঞা’র অভিযোগ আনলে মুগাবে ১৯৯৪ সালে পাওয়া সম্মানসূচক নাইট খেতাব ফিরিয়ে দেন। রাণী এলিজাবেথ এই খেতাব বাতিল অনুমোদন করেছিলেন।

তবে অনেকের চোখেই এরপরও হিরো ছিলেন মুগাবে। ২০১৫ সালের শেষ দিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের বিকল্প চীনের কনফুসিয়াস শান্তি পুরস্কার পান তিনি। অনুপ্রেরণামূলক জাতীয় নেতৃত্বের কারণে তাকে এই সম্মাননা দেয়া হয় বলে জানায় নির্বাচক কমিটি।

দেশটির মুদ্রাস্ফীতি বিশ্বের অন্য দেশগুলোর থেকে অনেক বেশি। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক এত বেশি পরিমাণে নোট ছাপিয়ে ফেলে যে, জিম্বাবুয়ান ডলারের দাম অতিরিক্ত কমে তীব্র মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিলের তথ্য অনুসারে, তখন মুদ্রাটির মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল ৫শ’ বিলিয়ন শতাংশ! এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে এই মুদ্রা বাতিল করে বন্ড নোট নামে নতুন মুদ্রা চালু করতে হয় সরকারকে।