তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কী শিখলে কোন কাজ ও চাকরির সুযোগ
নির্ঝর আনজুম: আমাদের চারপাশে অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেও উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছেন না। এর মূল কারণ হলো তারা যে বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন, চাকরির বাজারে সেই বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজের অভাব। এ থেকে বোঝা যায় চাকরির বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পড়াশুনা অনেক মূল্যবান।
বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি খুবই জনপ্রিয় একটি বিষয়। এই জনপ্রিয়তার কারণ হলো-
- এই বিষয়ে পড়াশুনার বই এবং উপাদানগুলো সহজলভ্য
- দেশি-বিদেশি চাকরি বাজারে প্রচুর কাজ পাওয়া যায়
- তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবসা করার অনেক সুযোগ রয়েছে
- শিক্ষা, চাকরি কিংবা ব্যবসা করবার জন্য আইটি বিষয়ে জ্ঞান আর কম্পিউটারই যথেষ্ট
- এটিই একমাত্র পেশা যে পেশায় ঘরে বসেও অনেক অর্থ উপার্জন করা সম্ভব
- এই পেশায় দেশে অবস্থান করেও বিদেশের কাজ করার মাধ্যমে প্রচুর উপার্জন সম্ভব
- আইটিতে কাজের বিভিন্ন ধরন থাকায় যেকোনো শিক্ষাগত বিভাগ, পেশা বা বয়সের মানুষ কোনো না কোনো ধরনের আইটি কাজের সাথে জড়িত হয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারে
- আইটির কাজগুলো যেহেতু ব্যবহারিক কাজ, তাই নন-আইটি বিভাগ থেকেও একজন মানুষ আইটি বিষয়ে পড়াশুনা এবং কাজ করতে করতেও অনেক দক্ষ হতে পারে
তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক কাজগুলো তিনভাবে করা যেতে পারে- ফ্রিল্যান্সিং করে, দেশের বাজারে চাকরি করে অথবা নিজে ব্যবসা করে।
এর মধ্যে ফ্রিল্যান্সিং সব থেকে জনপ্রিয়, কারণ দক্ষতার সাথে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে একজন মানুষ চাকরি থেকেও বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারে। তাছাড়া দক্ষতার সাথে ফ্রিল্যান্সিং করার অভিজ্ঞতা থাকলে চাকরি পাওয়া কিংবা ভবিষ্যতে নিজেই একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের ব্যবসা শুরু করার অনেক সম্ভাবনা থাকে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সঠিক দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় আমাদের দেশে অনেকেই আইটি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে কিংবা অনেক সময় সময় এবং অর্থ অপচয় করেও হতাশ হয়ে এই পথ ছেড়ে দিচ্ছে।
আমার লেখার ধারাবাহিক প্রকাশে আইটি, বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার নিয়ে আমি আলোচনা করব।
কাজ বেছে নিন
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক কাজ করে অর্থ উপার্জন করা খুব সহজ, ওয়েবসাইটে ক্লিক করে কিংবা নিজের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ডিজিটাল অ্যাড দিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায়- এমন ভুল ধারণা অনেকের মাঝে আছে। ইন্টারনেট ভিত্তিক এমন নানান ধরণের নন-আইটি কাজ শিখে কেউ কেউ অল্প কিছু উপার্জন করে ঠিকই, কিন্তু এই উপার্জন একটি সীমায় এসে আর উঠতে পারে না। অনেক সময় এমন কাজ শিখে সময় এবং অর্থ পুরোটাই বিফলে যায়।
আইটি ফ্রিলান্সিং এর সব থেকে লাভজনক কাজগুলোর কথা যদি বলা হয়, তাহলে প্রথম সারিতে রয়েছে ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওয়েবসাইট বা ওয়েব ভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরির কাজ) এবং গ্রাফিক্স ডিজাইনিং (ডিজিটাল ইমেজের কাজ)। এই কাজগুলো শেখা এই কারণে লাভজনক যে-
- এই শিক্ষাগুলো এমন নয় যে কদিন পর অচল হয়ে যাবে, বরং এগুলোর চাহিদা বাজারে সবসময় থাকবে
- ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটে এই কাজের পরিমাণ এবং পারিশ্রমিক অন্যান্য কাজের তুলনায় উভয়ই অনেক বেশি
- এই কাজগুলো শিখে আপনি শুধু অনলাইনেই নয়, বরং লোকাল মার্কেটেও কাজ পেতে পারেন
কী কী শিখবেন?
গ্রাফিক্স ডিজাইন
গ্রাফিক্স ডিজাইন বলতে সহজ ভাষায় ইমেজ কন্টেন্ট ডিজাইনিং, এডিটিং, কাস্টমাইজেশন এগুলোকে বুঝানো হয়। গ্রাফিক্স ডিজাইনের মধ্যে লোগো, লিফলেট, ব্রসিয়ার, ব্যানার, এবং অন্যান্য পেপার প্রিন্টিং কন্টেন্ট ডিজাইন করা বা ওয়েবপেজের জন্য ইমেজ কন্টেন্ট তৈরি করাকে বুঝানো হয়।
ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস ছাড়াও লোকাল মার্কেটে এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। যারা প্রোগ্রামিং করতে আগ্রহী নন বা নিজেকে দুর্বল মনে করেন বলে কাজ করতে চান না, তাদের জন্য এটি একটি চমৎকার পেশা হতে পারে যদি তাদের মোটামুটি কালার এবং স্টাইল সম্পর্কে ধারণা থাকে।
এই ধরনের কাজের জন্য একজন ব্যক্তিকে অন্তত অ্যাডোবি ফটোশপ ও অ্যাডোবি ইলাস্ট্রেটরের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে।
ওয়েব ডিজাইন
ওয়েব ডিজাইন বলতে সাধারণ ভাষায় ওয়েবসাইট বা ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের জন্য পেজ ডিজাইন করাকে বোঝানো হয়। বর্তমানে সমস্ত সফটওয়্যার কিংবা বিজনেসগুলোই ওয়েব ভিত্তিক, আর তাই ভালো ওয়েবসাইট ডিজাইনারের খুবই চাহিদা রয়েছে। একজন দক্ষ ওয়েব ডিজাইনার হতে হলে অন্তত প্রথমে যা শিখতে হবে তা হলো-
- এইচটিএমএল– ডিজাইনিং ল্যাঙ্গুয়েজ
- সিএসএস– স্টাইলিং ল্যাঙ্গুয়েজ
- বুটস্ট্রাপ– সিএসএসের একটি ফ্রেমওয়ার্ক
- জাভাস্ক্রিপ্ট– ব্রাউজার সাইড স্ক্রিপ্টিং ল্যাঙ্গুয়েজ
- জেকুয়েরি– জাভাস্ক্রিপ্টের একটি ফ্রেমওয়ার্ক
- অ্যাডোবি ফটোশপ– ইমেজ এডিটর
ওয়েবসাইটের পেজ/টেমপ্লেট তৈরি করে তা অনলাইনে বিক্রি করার মাধ্যমে, আবার ফ্রিল্যান্সিং কিংবা লোকাল মার্কেটে ক্লায়েন্টের ওয়েবসাইটের ডিজাইনের কাজ করে দিয়ে অনেক অর্থ উপার্জন করা সম্ভব। গ্রাফিক্স ডিজাইনের চাইতে তুলনামুলকভাবে বেশি অর্থ উপার্জন করা সম্ভব এই ধরণের কাজ করার মাধ্যমে। এ ধরণের কাজ শেখার আগে কিছুটা কম্পিউটার চালানো এবং ইন্টারনেট ব্রাউজ করার অভিজ্ঞতা থাকা ভালো।
ওয়েব ডেভেলপমেন্ট
ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বলতে মুলত ওয়েবসাইট এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা উভয়ই বুঝানো হয়। ওয়েব ডেভেলপমেন্টের ভেতর ওয়েব ডিজাইনের অংশ তো থাকেই, কিন্তু সব থেকে বেশি অংশ জুড়ে থাকে প্রোগ্রামিং। একটি ওয়েবসাইট কিংবা একটি ওয়েব ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন বা সফটওয়্যার কীভাবে কাজ করবে (ইউজারের রিকোয়েস্ট/কমান্ডের উপর ভিত্তি করে ফলাফল দেবে) সেগুলো কম্পিউটারের ভাষা দিয়ে তৈরি করাই মূলত প্রোগ্রামিং।
ওয়েব ডেভেলপমেন্টকে মোটামুটি ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটের সব থেকে দক্ষ এবং অর্থ উপার্জনকারী ক্ষেত্র বলা যেতে পারে। ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শিখতে গেলে কম্পিউটার চালানো এবং ইন্টারনেট ব্রাউজ করার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি ওয়েব ডিজাইনের মোটামুটি কাজ শিখে নেওয়া ভালো। আর তাহলে প্রোগ্রামিং শেখা তাদের জন্য বেশ সহজ হয়ে যাবে।
ওয়েব ডেভেলপমেন্টের বিভিন্ন ভাষা রয়েছে, তার মধ্যে সব থেকে বেশি ব্যবহৃত ভাষা হল পিএইচপি। তার কারণ হলো, আপনি যদি ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটের কাজগুলো লক্ষ্য করেন, দেখবেন যে মোটামুটি ৭০-৮০ ভাগ কাজ পিএইচপি ভিত্তিক। পিএইচপি’র সাথে আপনাকে মাইএসকিউএল শিখতে হবে ওয়েব ভিত্তিক সাইট বা সফটওয়্যারের ডাটা নিয়ে কাজ করার জন্য।
আর পিএইচপি, মাইএসকিউএল শেখার সব থেকে লাভ হলো অল্প সময়ে ওয়েব পোর্টাল, ই-কমার্স সাইট, ফোরাম, ব্লগ, ক্লাসিফাইড সাইট ইত্যাদি তৈরি করার জন্য যে সকল ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন আছে তার ৯০ ভাগই এই পিএইচপি আর মাইএসকিউএল দিয়ে তৈরি। এর মধ্যে আছে ওয়ার্ডপ্রেস, জুমলা, ওপেনকার্ট, ম্যাজেন্টো, পিএইচপিবিবি, ওএসক্লাস।
আপনি যদি পিএইচপি এবং মাইএসকিউএল ভাল করে রপ্ত করতে পারেন, তাহলে আপনি শুধু ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটে কেন, দেশি মার্কেটে অনায়াসে চাকরি কিংবা ব্যবসা করতে পারবেন। আর তার জন্য আপনাকে কম্পিউটার সায়েন্সে ব্যাচেলর করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সফটওয়্যার যেহেতু এক ধরণের প্রকৌশল, এখানে ব্যবহারিক চর্চার মাধ্যমে আপনি নিজের দক্ষতাকে অনায়াসেই গড়ে তুলতে পারেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক তরুণ-তরুণী ওয়েব টেকনোলোজি রপ্ত করে নন-আইটি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে পড়াশুনা করে এসেও অনেক ভালো করছে। শুধু প্রয়োজন চেষ্টা, দৈনিক চর্চা, আর ধৈর্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যারা আইটিতে এসে বিফল হন তাদের লক্ষ্য করলে দেখা যায় তারা একটু এগিয়ে একবার বিফল হলেই সাথে সাথে পিছপা হয়। ধৈর্য নিয়ে ৬ থেকে ৮ মাস কঠোর পরিশ্রম করলে এটা নিশ্চিত যে তাকে আর বেকার হয়ে বসে থাকতে হবে না।
আর আপনি ফ্রিল্যান্সিং করতে করতে যখন আপনার পোর্টফলিও বড় করে তুলবেন, তখন লোকাল মার্কেটেও ভালো চাকরি বা ব্যবসা করার সুযোগ খুলে যাবে আপনার সামনে।