জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন পেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বীকৃতি বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে পড়েছে।
ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিব থেকে সরিয়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের বিরোধপূর্ণ নগরী জেরুজালেমে নেয়ার সিদ্ধান্তকে ট্রাম্প স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই মুসলিম বিশ্বসহ বিশ্বনেতারা এর সমালোচনা ও বিরোধিতা শুরু করেন।
কিন্তু সেসব বিরোধিতা আমলে না নিয়ে, এমনকি নিজ দেশের মানুষের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দিলেন তিনি। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমোদনও দিয়েছেন। ট্রাম্পের এই একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত নতুন করে সহিসংতা ও রক্তপাতের কারণ হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্বনেতাদের অনেকেই।
ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি শান্তি প্রক্রিয়ায় অর্থ সহায়তা দেয়ার পর শান্তি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকার বরখেলাপ করার সামিল।
টেলিভিশনের জন্য ধারণকৃত এক ভাষণে মাহমুদ আব্বাস বলেন, ‘এই নিন্দনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপগুলো শান্তি প্রতিষ্ঠার সব চেষ্টাকে সরাসরি নষ্ট করে দিচ্ছে।’ জেরুজালেম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ‘শাশ্বত রাজধানী’ বলে জোরালোভাবে দাবি করেন তিনি।
ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ বলেছেন, ‘আমাদের ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী কখনোই এই ষড়যন্ত্র কার্যকর হতে দেবে না। তাদের হাতে অবশ্যই সুযোগ খোলা আছে নিজ ভূমি এবং নিজস্ব পবিত্র স্থানগুলোকে রক্ষা করার।’
দলটির একজন মুখপাত্র বলেছেন, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের দেয়া স্বীকৃতি ‘যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ পূরণের ক্ষেত্রে ওই এলাকায় নরকের দরজা খুলে দিয়েছে’।
ফিলিস্তিনিরা বরাবরই পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দাবি করে এসেছে। ১৯৯৩ সালের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি চুক্তি অনুসারেও জেরুজালেমের চূড়ান্ত স্ট্যাটাস আলোচনা করার কথা শান্তি আলোচনার শেষের ধাপগুলোতে।
সৌদি আরব
মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সৌদি রাজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বরা হয়েছে, ট্রাম্পের ঘোষণা ‘অন্যায্য এবং দায়িত্বহীন’।
অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেয়ার আগেই শুধু সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর মঙ্গলবার ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ সতর্ক করে বলেছিলেন, জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেয়া বা মার্কিন দূতাবাস সেখানে সরিয়ে নেয়া ‘বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের প্রতি একটি নৈতিক উস্কানি’ হয়ে উঠতে পারে।
মিশর
সৌদি বাদশাহ সালমানের মতো একই কথা বলেছেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি। তিনি বলেন, এই পদক্ষেপগুলো ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও জটিল করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ করে দেবে।
আরব লিগ
ট্রাম্পের এ স্বীকৃতিকে আরব লিগ একটি ‘বিপজ্জনক পদক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে যা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনসহ আশপাশের অঞ্চলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে ‘বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ভূমিকার দিকেও প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি।
তুরস্ক
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেয়া সিদ্ধান্ত দায়িত্বহীনতার পরিচয়। সামাজিক মাইক্রোব্লগিং নেটওয়ার্ক টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইন বহির্ভূত এবং সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘ নীতিমালা বিরোধী।’
Press Release of Turkey’s Foreign Ministry on US decision to move its Israel Embassy to #Jerusalem pic.twitter.com/5cpyHOSz3h
— Mevlüt Çavuşoğlu (@MevlutCavusoglu) December 6, 2017
ইরান
ইরান বলেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জেরুজালেম-স্বীকৃতি নতুন ‘ইন্তিফাদা’ বা আন্দোলন মাথাচাড়া দেয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের মতো ইরানেরও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে।
জর্ডান
জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি আগেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে সতর্ক করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। তারপরও জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেয়ায় এবার ‘এ সিদ্ধান্তের পরবর্তী ডালপালাগুলোকে সামলাতে’ জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়েছেন। জর্ডান সরকারের এক মুখপাত্র বলেছেন, ট্রাম্প একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের নীতিমালা ভঙ্গ করছেন।
লেবানন ও কাতার
লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, জেরুজালেমকে রাজধানীর স্বীকৃতি দান ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের শান্তি আলোচনাকে কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি বলেছেন, এটি শান্তিকামী প্রতিটি মানুষের জন্য মৃত্যুদণ্ডের সমতুল্য।
জেরুজালেম শহরটি একই সঙ্গে ইহুদি ও মুসলিমদের জন্য একটি পবিত্র ধর্মীয় নগরী। এ কারণে এর দখল এবং প্রবেশাধিকার নিয়ে বহু বছর ধরেই তীব্র দ্বন্দ্ব চলছে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মাঝে। ইসরায়েল সবসময়ই জেরুজালেমকে তার রাজধানী হিসেবে বলে এসেছে।
ফিলিস্তিনিদের দাবি, পূর্ব জেরুজালেম ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী। একেশ্বরবাদী তিনটি প্রধান ধর্মবিশ্বাস – ইহুদিধর্ম, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মে পবিত্র বলে বিবেচিত বেশকিছু স্থান ও স্থাপনা রয়েছে জেরুজালেমে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের পত্তনের পর বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ‘বর্তমান এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতার স্বীকৃতিস্বরূপ’ নেয়া হয়েছে। তবে এটি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয় এবং এই সিদ্ধান্তের ফলে জেরুজালেমের ভৌগলিক বা রাজনৈতিক সীমান্তে কোনো পরিবর্তন আসবে না বলেও জানানো হয়েছে।