চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

চলে যাবেন বলেই হয়তো স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছেন

মোনেম মুন্না একজন প্র‌য়াত বাংলাদেশী ফুটবল তারকা। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সেরা ডিফেন্ডারদের মধ্যে একজন তিনি। এক যুগ ধরে খেলেছেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের সাথে। আবাহনী ও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কও ছিলেন। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। এদিনে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন এটিএন নিউজের এডিটর ইনপুট শহিদুল আজম।

ফেসবুকে তিনি লিখেন, বিয়ের তিন দিন আগে প্রিয় ক্লাব, আবাহনীর বহিষ্কারাদেশ। বেদানহত হয়তো হয়েছেন তিনিও। কিন্তু তিনি যে কিংব্যাক মোনেম মুন্না। অত সহজে ভেঙ্গে পড়ার মানুষ নন। প্রতিপক্ষের শত আক্রমণের মুখেও মাঠে যিনি দলের দুর্ভেদ্য প্রাচীর আগলে রাখেন, তিনি মুষড়ে পড়বেন- সে কি করে হয়! লাখ লাখ ভক্ত যখন তার বহিষ্কারাদেশ নিয়ে ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী; মোনেম মুন্না তখন বরের পোশাকে সুরভীকে ঘরে তোলার আয়োজনে ব্যস্ত। আশির দশকেই মাঠ কাঁপানো এই ফুটবলারের পারিশ্রমিক ছিলো আকাশ ছোঁয়া- কুড়ি লাখ টাকা। শুধু দেশের ফুটবল নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় এ অঙ্কের পারিশ্রমিক তখন পাননি কোনো ফুটবলার। কাজেই তার বিয়ের অনুষ্ঠানে ক্রমাগত ক্যামেরার ফ্ল্যাশ পড়বে, রিপোর্টারদের ছুটোছুটি থাকবে, তারকার মিলনমেলা হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুন্না যে দুর্ভাগা! সোবহানবাগ কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে তার বহিষ্কারাদেশের স্পষ্ট প্রভাব। তবুও মুন্না দৃঢ় তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই। এক সময়ের প্রেমিকা সুরভীকে জীবনসঙ্গী করার মুহূর্তে অন্য কোনো কিছুই মাথায় আনতে চাইলেন না।

শহিদুল আজম বিয়ের দিনের আরো স্মৃতিচারণ করে লিখেন, মুন্নার সঙ্গে ক্রীড়া সাংবাদিকতার শুরু থেকেই আমার সম্পর্ক। এরপরও বিনা দাওয়াতে কভার করি তার বিয়ের অনুষ্ঠান। আমি তো আর খেতে যাইনি। বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়ে কিংব্যাক বিয়ের পিঁড়িতে, এর বিস্তারিত পাঠককে জানাবো না- তা কি করে হয়! সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলেই ঠিক করলাম কেউ যাক না যাক, মুন্নার বিয়ে আমি কভার করবোই। এ নিয়ে আমার প্রস্তুতি যখন চূড়ান্ত, তখন ফটো সাংবাদিক ইতস্তত করলেন। তিনি গেলেন না। তবে সার্কুলেশনের সহকর্মী রায়হান এগিয়ে এলেন। পাত্রী সুরভীর আত্মীয় তিনি। বিয়ে অনুষ্ঠানেও কন্যা পক্ষের আমন্ত্রিত। প্রস্তাব দিলেন, ‘আমার সঙ্গেই যাবেন।’ ব্যস, হয়ে গেল।

আর সেটি শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল আমার জন্যে সাপে বর। বিয়ের অনুষ্ঠানে আমাকে পেয়ে যারপর নাই খুশি মুন্না। তার বিয়ের একমাত্র বড় রিপোর্টটি প্রকাশের সুযোগ পেলাম আমিই। তিনি আমাকে শুধু জোর করে খাওয়ালেনই না, বানিয়ে ফেললেন স্ত্রী-পক্ষের আত্মীয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ সম্পর্কের কোনো হেরফের হয়নি। এরপর কোথায় তিনি নিয়ে যাননি আমাকে? গাজীপুরে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে শ্বশুরবাড়িতে, শীতলক্ষ্যার ওপারে বন্দরে নিজের বাড়িতে। তার সঙ্গে কত দাওয়াত খেয়েছি- এর কোনো হিসাব নেই। ’৯৫তে কলম্বোতে সার্ক ফুটবল কভার করার সময় মুন্না আমাকে নিয়ে যান আবাহনীতে তার সহযোদ্ধা পাকির আলীর বাসায় পর্যন্ত। সবাইকেই ‘না’ ‘না’ করে মুন্না যখন চলে যেতেন, তখনও আমার আত্মবিশ্বাস থাকতো, মুন্না অন্তত আমাকে ফেরাবেন না। তাই হয়েছে সব সময়।

এরপর আরো অনেক স্মৃতিচারণ করে এই সাংবাদিক লিখেন, একটা স্মৃতি এখনও আমার হৃদয়ে উজ্জ্বল। সেটি ’৯৫ সালের, কলম্বোর সার্ক ফুটবলে। তখন মুন্নার ফর্ম তুঙ্গে। আবাহনীর হয়ে ঢাকা আর ইস্টবেঙ্গলের হয়ে কলকাতার মাঠ কাপাঁচ্ছেন। কলকাতার ক্রীড়াপ্রেমীরা তার সর্বশেষ খবর জানতে চায়। কলম্বো গিয়েছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক রূপায়ন ভট্টাচার্য । তিনি বেশ ক’বার নিজের মতো করে মুন্নার সাক্ষাৎকার নিতে চাইলেন। পারলেন না। এক পর্যায়ে আমার সহযোগিতা চাইলেন। প্রবল আত্মবিশ্বাসে, চোখ বুঝেই বলে দিলাম, চিন্তা করবেন না। হয়ে যাবে। কিন্তু কে জানতো বিপরীত প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে আমাকে। মুন্নাকে কথাটা বলতে না বলতেই, তিনি ‘না’ করে দিলেন। আমি বললাম, কেনো? মুন্না বললেন, আপনারা চাইলেই কি ভারতীয় খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলতে পারেন? আমি মাথা ঝাঁকালাম। এবার তিনি বললেন, তাহলে আমি বলব কেনো? নিজেদের সম্মান রক্ষায়ই এমন আচরণ করেন তিনি।

মেনে নিলেও আমার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো, রূপায়ন ভট্টচার্যকে কি বলব এই ভেবে। মুন্না সেটি লক্ষ্য করলেন। জানতে চাইলেন, আমি রূপায়ন ভট্টাচার্যকে কথা দিয়ে ফেলেছি কী না। অপরাধীর ভঙ্গিতে বললাম, হ্যাঁ। মুন্না হাসলেন। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে জানালেন, আমার সম্মান রাখতেই তিনি রূপায়ন ভট্টাচার্যকে সাক্ষাৎকার দেবেন। আমি ভীষণ খুশি। রূপায়ন ভট্টাচার্য খুশি আরও বেশি। কৃতজ্ঞতায় গদ গদ। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি আমার পত্রিকার জন্যে নিজের টাকায় ফ্যাক্স করে বেশ কটি রিপোর্ট পাঠালেন। মুন্না এভাবে আমাকে কতবার বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। কতো অনুরোধে সায় দিয়েছেন- এর কোনো হিসাব নেই।

এরপর শহিদুল আজম আরো লিখেন, একবার আমার অনুরোধে বাংলাবাজার পত্রিকার ম্যাগাজিন খেলার বাজার-এর জন্যে ক্রিকেট পোশাক পরে দিনব্যাপী ফটো সেশনে অংশ নিয়েছিলেন। মাঠ ও মাঠের বাইরে এত বিশাল মনের একটা মানুষ ছিলেন মুন্না, সত্যি দুর্লভ। অপরিণত বয়সে চলে যাবেন বলেই হয়তো প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুন্না তার স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছেন তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে। তার দক্ষতায়। ভালোবাসায়। আমাদের অক্ষমতা আর সীমাবদ্ধতা এত বেশি বলেই হয়তো দেশের সর্বকালের অন্যতম এই সেরা ফুটবলারও হারিয়ে যাচ্ছেন বিস্মৃতিতে। ২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে চলে গেছেন মুন্না। তার বিদেহী আত্মা শান্তি পাক।