চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

অন্ধ চালায় বন্দুক, আইন ধরে ছাতা

অন্ধ ব্যক্তি বন্দুক চালাবে। তাকে অস্ত্র না বেচা আইওয়া রাজ্যের আইনের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেওয়া হবে, বলে দাবি করেন সে রাজ্যের একটি অন্ধকল্যাণ সমিতির প্রধান। নিউইয়র্ক টাইমসের ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের এক সংখ্যায় দেখা যে, অন্ধ অধিবাসীদের আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র বহনের অনুমতি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-পশ্চিমে অবস্থিত অঙ্গরাজ্য আইওয়ার আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ। শুধু বাড়িতে নয়, জনবহুল প্রকাশ্য এলাকায় যখন, তখন অস্ত্র বহন করতে পারবে। এই খবর আমেরিকার বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।

আমেরিকার আইওয়া রাজ্যে এখানে আবহাওয়া ও পরিবেশ সিনেমাটিক। সেখানের হোটেল রেস্টুরেন্টগুলির ডেকোরেশনে ট্রেক্সাসের কাউবয়দের বন্ধুক যুদ্ধের দৃশ্যপট আঁকা। এই রাজ্যে সবাই ঘরে ঘরে বন্ধুক রাখে অনেক বছর আগে থেকে। ২০১১ সালে নেওয়া নতুন এক আইনে আইওয়াবাসীকে প্রকাশ্য অস্ত্র বহন করার অধিকার দিয়েছে। আইওয়ার স্থানীয় আইনে অস্ত্র বহন এবং ব্যবহারের অনুমতি প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম আইনে উল্লেখ আছে। সেখানে কোথাও বলা হয়নি যে, কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধী বা অক্ষম ব্যক্তি অস্ত্র বহন করতে পারবে না।

মজার কথা সে সময় এমন তিন ব্যক্তিকে অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যাদের চোখের অসুবিধার কারণে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ওই তিন ব্যক্তি চোখে ঠিক দেখতে না পারার কারণে সামান্য একটি ফরম পূরণেও ব্যর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্রে অন্ধত্বের সংজ্ঞায় এদের দৃষ্টিহীন বিবেচনা করে। কিন্তু আইওয়ার আইনে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার অধিকার এবং কেনার অনুমতি দুই দিয়ে থাকে। এ ধরনের অনুমতি আইওয়ার সব শেরিফ অফিসে দেদারচ্ছে দিচ্ছে বলে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হয়েছে সে সময়।

১৯৬৭ সালে জেইন ম্যানসফিল্ড নামের এক মহিলার গাড়ি একটা ট্রাক্টর-ট্রেলারের পিছনে দিকে থেকে নীচে ঢুকে গিয়ে যায় ফলে তিনি প্রাণ হারান। এরপর থেকে ট্রাক্টর-ট্রেলারগুলির পিছনে ডট বাম্পার থাকা বাধ্যতামূলক করা হয় যাতে আর কোন গাড়ি বিশাল ট্রাক্টর-ট্রেলারের নীচে না ঢুকতে পারে।

১৯৮২ সালে টাইলেনল ওষুধ টেম্পারেডের সময় সাতজন মানুষ মারা যায়, তখন থেকে বাধ্যতামূলক তিনস্তরের প্রোটেকশন নেয়া হয় প্যাকেজিং’র সময়। ১৯৯৫ সালে এক বোমা হামলায় দেখা যায়, বোম তৈরিতে এক ধরনের সার ব্যবহার করা হয়েছে, সলিউসন গ্রেড অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, ওই হামলায় ১৬৮ জন নিহত, এরপর থেকে সরকার সার ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনেক কঠোর নিয়মনীতি আরোপ করে।ফ্লোরিডা-স্কুলে হামলা

২০০১ সালে এক ব্যক্তি, জুতা বোম দিয়ে প্লেন উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করে, এরপর থেকে প্রতিটি যাত্রীকে জুতা খুলতে হয় চেকিং’র সময় প্লেনে বোরডিং’র আগে।

১৯৬৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমেরিকার মাটিতে ১৫১৬৮৬৩জন মারা গেছে বন্দুকের গুলিতে। যা গড়ে প্রতি দুইদিনে ১৬৮ জন।

অবাক কাণ্ড একদুইজন মারা যাবার কারণে বিভিন্ন আইন প্রয়োগ করলো সরকার কিন্তু এতো মানুষ মারা যাবার পরো কেন অস্ত্র বিক্রি ও ব্যবহার আইন কঠোর হচ্ছে না। কয়েকদিন পর পর বন্দুক হামলায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। স্কুল পড়ুয়া শিশু থেকে মসজিদ, মন্দির ও চার্চে প্রার্থনারত মানুষ। মেলা অফিস, দোকানে। হসপিটালে। তারপরও কেন আইনপাশ হচ্ছে না! আর কেনই বা প্রতিকারে ব্যবস্থা না নিয়ে বারে বারে সাদা চামড়ার খুনিদের মানসিক রোগী বলে বিবেচিত করা হচ্ছে। কয়েকদিন পর পর গণখুনের ঘটনা ঘটে, বেশিরভাগ সময়ে এই খুনগুলি হয়ে থাকে একক ব্যক্তির রাগ, ক্ষোভ হতাশা থেকে।

কয়েকদিন পরপর যখন কোথাও মাসকিলিং’র ঘটনা ঘটে, তখন দেশের চারদিকে আওয়াজ ওঠে, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ জরুরি।পাঁচমাস আগে ৬৪ বছর বয়স্ক একব্যক্তির এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণে লাসভেগাসে নিহত হয়েছে ৫৮ জন। আহতের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়। লাস ভেগাস হত্যাকাণ্ড নিয়ে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের গুলিতে নিহত হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭০০। আর এ বছরের ২য় মাসে ১৯ বছরের যুবক নিকোলাস ক্রুজের হাতে ১৭ জন স্কুল ছাত্র-ছাত্রীসহ শিক্ষকের প্রানহানী হল। পাঁচ বছর আগে কানেকটিকাটের এক প্রাথমিক স্কুলে এক যুবকের এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণে ২৬ জন শিশুর মৃত্যুর পর জোর আওয়াজ উঠেছিল, এখনই একটা কিছু করতে হবে।

ফ্লোরিডা-স্কুলে হামলাদুবছর আগে আফগান যুবক অরল্যান্ডোর এক নাইট ক্লাবে গুলি চালিয়ে ৪৯ জন নারী-পুরুষকে খুনের পর আবার সবাই দাবী উঠিয়েছিল। এই দাবি নিয়ে কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটরা সারারাত আইনসভা কক্ষ ঘেরাও করে রেখেছিলেন। কিন্তু নটে গাছটি মুড়েনি অর্থাৎ কোন কর্ণপাত করেনি আইন প্রনেতারা। ফ্লোরিডায় স্কুল হত্যাকান্ডের পর আবারো সেই একই দাবি উঠেছে, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করতে হবে। দু বছর আগে এক ডেমোক্রেটিক সিনেটর বলেছিলেন, যারা বিপক্ষে, তাঁদের পশ্চাদ্দেশ গুঁতিয়ে হলেও একটা কিছু করতে হবে। কিন্তু বলা বাহুল্য যে কিছুই হয়নি।। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে এ পর্যন্ত কে কোন উদ্যোগ নিয়েছে, তার এক ফিরিস্তি দিয়ে সাবেক ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান স্টিভ ইসরায়েল নিউইয়র্ক টাইমস-এ এক নিবন্ধে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, এবারও কিছু হবে না।

সারা দেশের মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত প্রকাশ করলেও আজো এব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। কারণ আমেরিকার গান লবি। আমেরিকার মানুষের পক্ষে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন বা এনআরএ মূলত মেইন লবিং গ্রুপ। এই গ্রুপ বছরে ২৫ থেকে ৩০ কোটি ডলার কংগ্রেসের বিভিন্ন মেম্বারকে এফেক্টেড বা প্রভাবিত করার জন্য ব্যয় করে। নিউইয়র্ক টাইমের এক রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৬ সালের নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষের প্রার্থীদের জন্য তারা সরাসরি খরচ করেছে ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। এনআরএর যুক্তি, অস্ত্র হাতে একজন বাজে লোককে ঠেকানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো একজন ভালো লোকের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া। আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ এনআরএ’র এই যুক্তি বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। বিশ্বাস করছে যে নিজের ঘরে বন্দুক থাকলে নিরাপদে থাকা যায়। আর এই কারণে আমেরিকায় ব্যক্তিগত অস্ত্র ৩০ কোটি। আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশিওলজির গবেষকরা ১৭১টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে ‘মাস শুটার’ নামের এক রিপোর্টটি তৈরি করেছে। রিপোর্টের গবেষণায় দেখা যায় গত ৪৬ বছরে আমেরিকায় যে পরিমাণ বন্দুকবাজের হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা সারা বিশ্বের তুলনায় একত্রিশ শতাংশ ৷ দ্বিতীয় স্থানে থাকা ফিলিপাইনে সারা বিশ্বের তুলনায় ১৫শতাংশ বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে৷

বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটি আধুনিক অটোমেটেড আগ্নেয়াস্ত্রের প্রাইভেট লাইসেন্স রয়েছে আমেরিকায়৷ সেখানে আমেরিকার জনসংখ্যা খুব বেশি হলে মাত্র ৩৫ কোটি ৷ হিসেব বলছে ৩৫ কোটি জনসংখ্যার দেশে ৩০ কোটি ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র আছে৷ কিম্বা সহজভাবে বলা যায়, একজন মার্কিনীর কাছে একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে৷ শুধু তাই নয়, সমীক্ষা বলছে আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৪৭ শতাংশই তাদের বাড়িতে আগ্নেয়াস্ত্র রাখেন ৷লাস ভেগাসে হামলা-স্টিফেস প্যাডক

২০০৭ সালে আমেরিকার কংগ্রেসে একটি অস্ত্র আইন পাস হয়। সেখানে বলা হয়েছিল, ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের ইতিহাস জেনে তার কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে। কারণ সে সময় মানসিক স্বাস্থ্যের ইতিহাস না জানা থাকায় এক বিকৃত মস্তিষ্কের তরুণের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা হয়েছিল। পরে সে ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২ জনকে গুলি করে হত্যা করে। একই রকম প্রস্তাব ২০১৪ ডিসেম্বরে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর ড্যানি ফিয়েস্টাইন সিনেটে এনেছিলেন। যখন ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নারডিনোয় ১৪ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু রিপাবলিকানদের বিরোধিতার কারণে সেই আইন পাস করা যায়নি। কারণ সিনেটে তখন রিপাবলিকানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল।

১৭৯১ সালে মার্কিন শাসনতন্ত্রের দ্বিতীয় সংশোধনীতে এ দেশের নাগরিকদের অস্ত্র বহনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, দেশি বা বিদেশি যেকোনো সরকারের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে নিজের আত্মরক্ষার জন্য ‘ওয়েল কন্ট্রোল’ মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য হিসেবে প্রত্যেক নাগরিককে অস্ত্র বহনের অধিকার দেওয়া হলো। এই আইন তৈরি তখন, যখন আমেরিকা সদ্য এক ঔপনিবেশিক যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সে সময় সারা দেশের মানুষের নিশ্চিত নিরাপত্তা দিয়ে পারছিলোনা সেন্টাল গভমেন্ট। ফলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্টেটের গভমেন্টের হাতে, এরা নিজস্ব মিলিশিয়া গঠনের পাশাপাশি নাগরিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেবার ক্ষমতা রাখতো। ২০০ বছরের পুরানো ২য় সংশোধনীর ধূয়ো তুলে, ডোনাল্ড ট্রাম্প, ন্যাশনাল রাইফেলস অ্যাসোসিয়েশন, গান লবিং গ্রুপ ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা আগ্নেয়াস্ত্রের কেনা ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের আইন সব যুক্তি ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয়, আর ফলে কিছু দিন পর সাধারণ আমেরিকানরা হারায় স্বজন, বাতাস ভারী হয়ে ওঠে সন্তান হারা মায়ের হাহাকারে। বিষাদে ছেয়ে যায়

একেকটি স্বজন হারা পরিবার।

জানি আমেরিকায় অস্ত্র রাখার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। এ কারণে দেশটিতে অস্ত্র কেনা ও রাখা মামুলি বিষয়। তবুও বারবার মনে হয় আর কত প্রাণ গেলে সংশোধনী আসবে আগ্নেয়াস্ত্র কেনা ও ব্যবহার নীতিতে। নাকি যতক্ষণ না সর্বোচ্চ পর্যায়ের কারো সন্তান, পরিজন এইভাবে হারিয়ে যাবে ততোক্ষণ এদের টনক নড়বে না। পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতার দেশের স্কুলে নেই বাচ্চাদের নিরাপত্তা। আমরা নিরুপায় হয়ে, দুরু দুরু বুকে সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে আতংকে থাকবো নাকি অস্ত্র কিনে বাচ্চার হাতে তুলে দেব তার নিরাপত্তার জন্য? আমরা শুধু সন্তানের নিরাপদে ঘরে ফেরার আশায় প্রার্থনা করবো। আমাদের প্রার্থনা পৌছেবে না, ক্ষমতালোভীদের কাছে যারা ডলারের ঝনঝনানিতে, চমকে অন্ধ বধির হয়ে আছে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)